
বাংলার বার্তা ডেস্কঃ
গত দেড় দশকে কওমি অঙ্গনের যেসব তরুণ সামনের কাতারে থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বাংলাদেশ ইসলামী যুবসমাজের কেন্দ্রীয় সংগঠন সচিব মাওলানা এহতেশামুল হক সাখী। জুলাই অভ্যুত্থানেও ছিল তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ। আন্দোলন-সংগ্রামের সেই উত্তাল দিনগুলোতে নানা ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়েছেন এই তরুণ আলেম।
অভ্যুত্থানের নানা অভিজ্ঞতা, স্মৃতিচারণ ও অভ্যুত্থান পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন । যেখানে ফুটে উঠেছে আন্দোলনে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের অসীম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আবেগঘন বর্ণনা।
আমি সরাসরি মাঠে থেকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি তখন দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় সভাপতি। আমরা সাংগঠনিকভাবে শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী এ আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করি। সেই সাথে সহযোদ্ধাদের নিয়ে অনেকটা শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে তৎপর থাকার চেষ্টা করেছি নানা প্রতিকূলতার মাঝেও। আর আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে একটা ছাত্র ঐক্য ছিল। সে সুবাদে আমরা শুরু থেকেই সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখছিলাম। যৌক্তিক এ আন্দোলনকে কিভাবে বেগবান করা যায় সে বিষয়ে আমাদের ছাত্র ঐক্যের বৈঠকে বারবার আলোচনা হতো।
১৭ জুলাই রাতে যাত্রাবাড়ীতে ছিলাম। সেখানে শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সংগ্রামমুখর সে সময়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পুরো রাত নির্ঘুম থেকে ফজরের আগেই যাত্রাবাড়ী থেকে পল্টন চলে আসি।
১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা ভাইসহ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পল্টন মোড় ব্লক করবো। যেই কথা সেই কাজ। মাগরিবের আগেই পল্টন মোড়ে আমরা ছাত্রজনতা অবস্থান নিলাম। সেখানেই মাগরিবের জামাত হলো। নামাজের পর থেকেই ছাত্রজনতার সাহসী স্লোগান চলছিল। কিছুক্ষণ পর পর ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। আমরাও তাদেরকে মোকাবেলা করছিলাম। সেই রাতে পল্টন মোড়ে আমার সাথে সহযোদ্ধা আমির জিহাদী (যিনি বর্তমানে ইসলামী ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় সভাপতি), ছাত্রনেতা নিজাম উদ্দিন আল আদনান, আহমেদ ইসহাক, মোশাররফ ভাই, জামিল সিদ্দিকী ও আহমদ আব্দুল্লাহ মুসাসহ আরো অনেকেই ছিলেন।
১৯ জুলাই জুমাবার। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম পুনরায় পল্টন মোড়ে জমায়েতের। সকাল থেকেই পল্টন মোড়ে বিভিন্ন দল ঝটিকা মিছিল সহকারে অবস্থান নিতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের বেপরোয়া আক্রমণে আমরা বিভিন্ন গলিতে অবস্থান নিই। পুলিশ অনবরত টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছে। এমনকি জাতীয় মসজিদের ভেতরেও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আন্দোলনকারী বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো তারা। তবে মসজিদের ভেতরে কিছু ভাইদের সহযোগিতার কারণে আমরা কোনোভাবে মসজিদে প্রবেশ করতে পেরেছিলাম।
এভাবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুরো সময়টা পুরানা পল্টনস্থ আমাদের নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে আন্দোলন বেগবান করার নানা পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও মাঠপর্যায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আসছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত না করে ঘরে ফিরবো না। কারণ, ফ্যাসিবাদের পতনের লক্ষ্যে একজন সচেতন নাগরিক ও ছাত্রনেতা হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল।
প্রকৃত অর্থে কওমি অঙ্গনের শিক্ষার্থীরা কোনো বিনিময়ের জন্য সংগ্রাম করেনি। শুধুমাত্র দেশের ভালোবাসায় দেশকে জালেমের শাসন থেকে উদ্ধার করতেই লড়াই করেছে, সংগ্রাম করেছে। তবে সকল ত্যাগেরই একটি মর্যাদা ও স্বীকৃতি থাকাটা নীতিসঙ্গত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তেমন কিছুই আমরা পাইনি।
ইতোমধ্যে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অবদান স্মরণে সরকার একটি দিবস ঘোষণা করেছে। সেদিনকে ঘিরে সারাদেশে তাদের স্মরণে দোয়া মাহফিল ইত্যাদি কিছু আনুষ্ঠানিকতা হবে (এরই মধ্যে দিনটি অতিবাহিত হয়ে গেছে)। আমি মনে করি- শুধু এতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। শাহাদাতবরণকারী ভাইদের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, স্থায়ী আর্থিক সুবিধা এবং কওমি অঙ্গনকে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করতে হবে। জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদে আলেমসমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ ও বলিষ্ঠ অবদানের মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি থাকতে হবে।
আন্দোলন চলাকালে প্রতিমুহূর্তে হেফাজতে ইসলাম সাহসিকতার সাথে কাজ করেছে। যখন কোনো সংগঠন আন্দোলনকারীদের পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি, সেই সময় হেফাজতে ইসলাম চৌকস ও সাহসী অভিভাবকের ভূমিকায় ছিল। হেফাজতের প্রতিটা পদক্ষেপ আন্দোলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ব্যানার বিহীন আন্দোলন দেশের মানুষের একটা জোরালো দাবি ছিল। তেমনই আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে কওমি আলেমগণ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।
আন্দোলন চলাকালে প্রতিমুহূর্তে গ্রেফতার আতঙ্কে থাকতে হতো। একবার তো প্রায় গ্রেফতার হয়েই গিয়েছিলাম। আমরা যে ভবনে অবস্থান করছিলাম, পাশের ভবনের কেয়ারটেকার আমার আসল পরিচয় গোপন করে অন্য পরিচয় দিয়েছিলেন। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম, এভাবেই আমরা খুব আতঙ্কে সময় পার করতাম।
আন্দোলনে অংশগ্রহণের পেছনে তাদের নৈতিক ও আদর্শিক প্রেরণা ছিলো বৈষমমুক্ত, ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইসলামের শিক্ষা ও স্বচ্ছ দেশপ্রেম। কওমি মাদরাসায় খুব গুরুত্বের সাথে এ বিষয়গুলো শেখানো হয়।
ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকাকালীন বিভিন্ন বিকল্প অ্যাপস ব্যবহার করে নেট সচল রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কখনো সব কিছু বন্ধ হয়ে গেলে ধৈর্য ধরে পরবর্তী সংবাদের অপেক্ষায় থাকতাম। সবরের সাথে চেষ্টা ও দোয়া জারি রাখতাম।
আমি মনে করি এক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামই ছিলো ঐক্যের সেতুবন্ধন। কারণ, কওমি শিক্ষার্থীরা ইসলাম ও দেশের যেকোনো ইস্যুতে হেফাজতের নির্দেশনাই বাস্তবায়ন করে থাকে।
ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যমুক্ত একটি আলোকিত বাংলাদেশ চাই। আর একমাত্র ইসলামী নেজাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব তেমন বাংলাদেশ গড়া। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপে যেকোনো বৈধ পন্থায় সংসদে উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমেই সে পথ সুগম করতে হবে।